দিনটি ঠিক মনে নেই, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে হবে। খুব সকালে
প্রথম আলোর প্রধান বার্তা সম্পাদকের ফোন, ফোন ধরতেই বললেন, আজকের ডেইলি
স্টার দেখেছেন? বললাম, না, পত্রিকা এখনো আসেনি। বললেন, পত্রিকাটা দেখে ফোন
দেবেন। অনেক সময় অপেক্ষার পর পত্রিকাটি যখন এল, দেখলাম ওই মাদ্রাসার
এমপিওভুক্তি না হওয়ার কারণে শিক্ষকেরা দিনমজুরি করছেন এমন একটি সংবাদ ছাপা
হয়েছে।
পরে তিনি আমাকে বললেন, আপনি এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখেন প্রতিবেদন করার মতো কিছু পাওয়া যায় কি না।
একদিন সকাল সকাল ছুটলাম জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ওই
মাদ্রাসায়। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা জানালেন, কয়েকজন শিক্ষক খুবই
গরিব। তাই তাঁরা মাঝেমধ্যে দিনমজুরিও করেন। কিন্তু রঞ্জিত কুমার রায় নামের
একজন শিক্ষক তখনো মাদ্রাসায় অনুপস্থিত। অনেক চেষ্টার পর মাদ্রাসার সুপার
গোলাম মোস্তফা বললেন, উনি দুপুরের পর ক্লাস নেন। এখন কোথায় জানতে চাইলে
বলেন, অনেক দূরে ভাটায় কাজ করেন। তাঁর কথামতো ছুটলাম সেখান থেকে প্রায় ১৫
কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নে এবিএল (২) ইটভাটায়।
গিয়ে দেখলাম, অন্য দিনমজুরদের মতো একজন শিক্ষকও ইটের বোঝা টানছেন। দৃশ্যটি
দেখে চোখে পানি এসে গেল।
ফাল্গুনের ভরদুপুর, রোদটা বড্ড কড়া হয়ে উঠেছে। দরদর করে ঝরছে ঘাম। ইটের
ভারী বোঝায় টন টন করছে ঘাড়টা। মাথায় গামছা পেঁচানো, গায়ে একটি ছেঁড়া ময়লা
গেঞ্জি, পরনে ছেঁড়া ফুল প্যান্ট। সামনে গিয়ে তাঁর পথ রোধ করে জিজ্ঞেস করি,
আপনি কি রঞ্জিত স্যার?
চমকে গেলেন। ইটের বোঝাটা আর কাঁধে রাখতে পারলেন না। সেখানেই রেখে লজ্জাবনত
কণ্ঠে বললেন, কেন? আপনার পরিচয়? পরিচয় পেয়ে তিনি প্রথমে আন্দাজ করে
নিয়েছিলেন হয়তো মাদ্রাসা ফাঁকি দিয়ে কাজ করার অপরাধে সাংবাদিকের নানা
প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
আপনি কি বেড়াকুটি বরুয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক? জবাব এল, হ্যাঁ, আমাদের
মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হয়নি, তাই বেতন পাই না। প্রথম বেলাটা ভাটায় কাজ করি,
দ্বিতীয় বেলায় ক্লাস নিই। আমার মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আমি কাজ করছি।
আমার কোনো জমিজমা নেই, মাদ্রাসায় বেতন পাই না, সংসার চলে একবেলা দিনমজুরির
১০০ টাকায়।
তাঁর পুরো নাম রঞ্জিত কুমার রায়, বয়স ৩৬ বছর। তাঁর বাড়ি দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার ডুবুলিয়া গ্রামে।
১৯৯৫ সালে দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন, ২০০০ সালে তাঁর বাড়ি
থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নীলফামারী জেলা সদরের সোনারায় ইউনিয়নের বেড়াকুটি
বরুয়া দাখিল মাদ্রাসায় চাকরিতে যোগ দেন। এ জন্য মাদ্রাসার উন্নয়নে টাকা
দিতে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ১৫ শতাংশ জমি বিক্রি করতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১১
বছরেও মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় কোনো বেতন পান না।
গৃহশিক্ষকের কাজ করেন না কেন? এলাকাটা খুবই দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা। কে টাকা
দিয়ে ছেলেমেয়েকে পড়াবে। যাঁদের একটু সামর্থ্য আছে, তাঁরা ছেলেমেয়েদের শহরে
পড়ান।
রঞ্জিত স্যারের এই ‘এক বেলা শিক্ষকতা, অন্য বেলা দিনমজুরি’ শিরোনামে ২০১১
সালের ৯ মার্চ প্রথম আলোয় একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পরে। অনেকেই রঞ্জিত
স্যারকে সহযোগিতার হাত বাড়াল। পাঠকদের অনুরোধে রঞ্জিত স্যারের একটি ব্যাংক
হিসাব খোলা হলো। কেউ ব্যাংক হিসাবে, কেউ কুড়িয়ার সার্ভিসে, আবার কেউ বা
নিজে এসে রঞ্জিত স্যারকে সহযোগিতা করলেন।
অনেকে রঞ্জিত স্যারের একটি থাকার ঘর ও মাদ্রাসার ঘর নির্মাণের জন্য প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাতে থাকেন।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান পাঠকদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তহবিল গঠন করলেন,
ওই তহবিলে জমা তিন লাখ ৫০ হাজার, এর সঙ্গে প্রথম আলো ট্রাস্ট তহবিল থেকে
প্রায় এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার টাকায় করা হলো শিক্ষকের
পরিবারের জন্য একটি আধাপাকা টিনের ঘর, ল্যাট্রিন ও টিউবওয়েল এবং মাদ্রাসার
জন্য একটি ক্লাসরুম, ল্যাট্রিন ও টিউবওয়েল।
স্থানীয় সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর আশ্বস্ত করলেন নীলফামারী জেলায় যদি একটি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়, সেটি হবে রঞ্জিত স্যারের বেড়াকুটি বরুয়া
দাখিল মাদ্রাসা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ওই সময় থেকে অদ্যাবধি
নীলফামারী জেলায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি।
কেমন আছেন রঞ্জিত স্যার—জানতে সম্প্রতি (শুক্রবার সকালে) গিয়েছিলাম
ডুবুলিয়া গ্রামে। রঞ্জিত স্যার তখন প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে করে দেওয়া
তাঁর ঘরের বারান্দায় মেয়ে শিশুশ্রেণীর ছাত্রী ভূমিকা রানী রায় ও ছেলে পঞ্চম
শ্রেণীর ছাত্র রিপন রায়কে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। স্ত্রী সৈব্যা রায় তাঁদের
পাশে অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলেন।
এ সময় কথা বললে রঞ্জিত বলেন, ‘বাচ্চাদের একটু পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। এখনই
দোকান খুলতে যেতে হবে। কারণ আজ শুক্রবার মাদ্রাসা বন্ধ আছে।’
প্রথম আলোয় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশ-বিদেশের পাঠকদের
সহযোগিতায় তিনি ওই গ্রামে তাঁর বাড়ির পাশে ক্যানেলের বাজারে একটি ওষুধের
দোকান খুলেছেন। এখন একবেলা ভাটায় দিনমজুরির বদলে একবেলা ওষুধের দোকান
চালান। এখান থেকে প্রতিদিন ৫০-১০০ টাকা আয় হয়। এখন কেমন আছেন? জবাব আসে
ভগবানের কৃপায় আপনাদের আশীর্বাদে ভালো। দোকান কেমন চলছে? খুব ভালো না। কোনো
রকম দিন যাচ্ছে।
কথা বলে জানা গেল, তিনি যে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন সেখান থেকে কিছু
ঋণমহাজন পরিশোধ করেছেন, আর এক লাখ টাকা দিয়ে একটি দোকানঘর করে সেখানে কিছু
ওষুধ রেখে কেনাবেচা করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার জীবন যখন মৃতপ্রায়, তখন প্রথম আলো আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে
বাঁচিয়ে গোটা বিশ্বে আমার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে। ক্ষুদ্র এই মানুষটাকে বৃহৎ
মানুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদকের মতো একজন এত বড়
মানুষ আমার বাড়িতে এসেছে, এরপর আর আমার চাওয়া-পাওয়ার কী থাকতে পারে। প্রথম
আলো পরিবারের সবার জন্য আমাদের শুভকামনা।’
---------------------------------------------------------------------------
(লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)